রাজেশ মজুমদার :
জাতিগোষ্ঠীতে বৈচিত্রপূর্ণ দেশ মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে যারা আটটি প্রধান ভাগে বিভক্ত- বামার, কাচিন, কাইয়াহ, কাইন, চিন, মুন, রাখাইন, শান ও অন্যান্য (ওয়া, নাগা, লাহু, লিসু ও পালাউঙ)। এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠি যারা মিয়ানমারের জাতিসত্ত্বার মূলধারা বহন করে তারা ‘বামার’ হিসেবে পরিচিত। এ সংখ্যা মাত্র ৬৮ শতাংশ, জনসংখ্যার বাকী অংশ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত সংখ্যালঘু জাতি, যাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি আছে।প্রায় ৬ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মায়ানমারের শতকরা ৮৭ ভাগ বৌদ্ধ, ৬ ভাগ খ্রীষ্টান, ৪.৩ ভাগ মুসলিম বাকী হিন্দু, নাস্তিক এবং উপজাতীয় সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সিংহভাগই বর্মী মুসলিম, বাকীরা উপজাতীয় মুসলিম সম্প্রদায়-যেমন : রোহিঙ্গা, পান্তুই, মালোয়, জেরবাদী । বর্মী মুসলিমরা মূলত ইয়াংগুনে বসবাস করে। মায়ানমারের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১.৩ ভাগ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উপরই অমানবিক নির্যাতনের খবর গত কয়েক দশকের নিয়মিত সংবাদ হলেও বাকী মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের খবর তেমন শোনা যায়না। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের মুখ্য কারণ বর্মী এবং রোহিঙ্গাদের বৈরীতার পূর্ব ইতিহাস। বাংলাদেশে গোবিন্দগঞ্জে যখন সাঁওতালদের উপর নির্যাতন যেমন ‘হিন্দু নির্যাতন’ নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন চাকমাদের স্যাটেলারদের দ্বারা নির্যাতিত যেমন ‘বৌদ্ধ নির্যাতন’ নয় বা এদেশের বিলুপ্ত প্রায়ই মুসলিম আদিবাসী পাঙ্গন’দের নির্যাতন যেমন ‘মুসলিম নির্যাতন’ নয় তেমনি রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন ‘মুসলিম নির্যাতন’ নয়, এটা মূলত ধর্মীয় নয় জাতিগত নির্যাতন। সবচেয়ে বড় কথা হলো: মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান নয়, নির্যাতিত হচ্ছে মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব !!! ১৪৩০-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আজকের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষদের প্রায়ই ২২হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন রাজ্য ছিল নাম :রোসাং’। বর্মী ‘বোদাওফায়া’ হাতে রাজ্য হারানোর পর থেকেই রোহিঙ্গাদের দুঃখের শুরু হয়।ব্রিটিশেরা মায়ানমারে উপনিবেশ স্থাপন করার পর রোহিঙ্গা নির্যাতন কিছুদিন থেমে থাকলেও তাঁদের অনেক বড় ক্ষতি হয় তখন। ব্রিটিশদের করা নৃ-গোষ্ঠির তালিকায় ১৩৯ টি নৃ-গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত হলেও, এই তালিকায় রোহিঙ্গারা বাদ পড়ে। ১৯৪৮সালে মিয়ানমার যখন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে কিছুদিনের জন্য, এই নির্যাতন বন্ধ হয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আশায় বৃটিশদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে (বৃটিশকে) সমর্থন এবং জাপানি শক্তির বিরোধিতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র এবং পরবর্তী সময়ে গোপন পথে অস্ত্র সংগ্রহ করে তৎকালীন পাকিস্তানি ও তুর্কিদের মদদে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন অধিবাসী মগদের বিরুদ্ধে ‘মোজাহিদ বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি’রা ভালভাবে গ্রহন করে নাই। মায়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রোহিঙ্গারা পাকিস্তানের সাথে থাকতে চাওয়ায় বর্মীদের কাছে চিহ্নিত হয় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে এবং তারও পূর্বে ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ক্ষোভ এক হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্মীদের বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করে। সর্বশেষ ১৯৬২ সালে ‘নে উইন ‘ এর সামরিক অভ্যুত্থানের পরে শুরু হয় চুড়ান্ত রোহিঙ্গা নির্যাতন।জেনারেল নে-উইন আরাকানে জাতিগত আন্দোলন দমনের জন্য যে নয়টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ‘নাগামিন ড্রাগন অপারেশন’।এই অপারেশনের ফলে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসে পরে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামের চাপের মুখে নে-উইন সরকার তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নেন। নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে তারা সাংবিধানিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে, তাঁদের জাতিগত স্বীকৃতি হরণ করে, শিক্ষার অধিকার হরণ করে তাঁদের ভাসমান নাগরিক ঘোষণা করা হয়। তাঁদের বিয়ে করার বৈধতা নেই, নেই তাদের সন্তান জন্মদানের মত নায্য অধিকারও।
চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কটের পিছনে রোহিঙ্গাদের দুইটি রাজনৈতিক ভুল, একটি রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা ও একটি পাপ রয়েছে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের সমর্থনে জাপানি বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান, আন্তর্জাতিক ধর্মীয় রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়ে মোজাহিদ বাহিনী নামক ধর্মভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গঠন করে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন পরিচালনা, মিয়ানমারের গণতন্ত্রের আন্দোলনে সুচির এনএলডিকে সমর্থন দান এবং বৌদ্ধ রমনীকে বলাৎকার ও হত্যা। ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় বিচার্য যে, রোহিঙ্গাদের কোন আন্দোলন কখনোই ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না, ধর্ম রক্ষার্থে কখনো তারা কোন সংগ্রাম করেনি। বরং প্রতিটি কর্মকাণ্ডে তারা বিচ্ছিন্নতাকামীর পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রপন্থি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ফলে, কালে কালে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তারা ‘বামার’ বা বার্মিজদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। বার্মিজদের জাতিসত্ত্বাবোধ এতটাই প্রবল যে, ‘বার্মা’ থেকে ‘মিয়ানমার’ নাম পরিবর্তনের সিলভার জুবিলি পার হয়ে গেলেও বার্মিজদের দেশ হিসেবে বার্মা নামটি এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে প্রচলিত আছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার ও শরনার্থী বিষয়ক সংগঠন ‘UNHCR’ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বরাবরের মত তারা আবার বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় দেয়ার কথা বলেছেন। অথচ তারা রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে চুপ। মিয়ানমার রাষ্ট্র ও রোহিঙ্গাদের যে দ্বন্দ্ব কালে কালে বৌদ্ধ-মুসলিম দ্বন্দ্বের তকমায় রঙ ছড়ানো হয়েছে, সেই রঙই সুচির কাছে এ বিষয়ে কোন সহানুভূতি দেখানোর পথে, সমাধান খোঁজার পথে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। ৮৯% বৌদ্ধ অধ্যুষিত এই দেশে কোন কোন বৌদ্ধ নেতা নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন দুঃসাহস দেখাবে বলে মনে হয় না। তাই আন্তর্জাতিক চাপই রোহিঙ্গাদের একমাত্র ভরসা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে রোহিঙ্গারা পাকিস্তানীদের কে সহায়তা করার কথা ভুলে গিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় দিয়েছে। ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশে জন্য এই বিশাল শরণার্থীর চাপ হিমালয়তুল্য। বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশ শরণার্থীর যন্ত্রণা বুঝে বলেই মায়ানমায়ের বৈরীতায় ঝুকি মাথায় নিয়েও শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে, দিনের পর দিন তাদের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। মালয়েশিয়ার মত ত্রাণ হিসাবে সেম্পু পাঠিয়ে বা তুরস্কের ফাস্ট লেডির মত চাউল,শুটকি আর কাপড় মিলিয়ে ১ টন ত্রাণ নিয়ে এসে ফটো সেশন করে বাহবা নিতে নয়, বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদেরকে তাঁদের মাতৃভূমি নিপত্তার সাথে বাসোপযোগী করে তাঁদের স্বভূমিতে ফেরত পাঠিয়ে এর স্থায়ী সমাধান। আর রোহিঙ্গা সমাস্যার সমাধান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যই জরুরী।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া, পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন ব্লগ ও মিয়ানমারের উপর লেখা কিছু গবেষণাধর্মী কলাম।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- » বাংলাদেশ সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ ফেনী জেলা আহবায়ক কমিটি গঠিত
- » ফেনী বন্ধুসভার বৃক্ষরোপণ ও বিতরণ
- » আমার দেশ সম্পাদকের রত্নগর্ভা মাতা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের মাগফিরাত কামনায় ফেনীতে দোয়া
- » গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ফেনীতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন
- » ফেনীতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাংবাদিকদের উপর হামলার গোপন পরিকল্পনা ফাঁস
- » জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যানের উপর হামলা, সংবাদ সম্মেলন
- » ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন
- » ফেনীতে হেফাজতের দোয়া মাহফিলে আজিজুল হক ইসলামাবাদী- ‘আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশে আর ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হবে না’
- » ফেনীতে হাফেজ তৈয়ব রহ. স্মরণে দোয়ার মাহফিল
- » ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ফেনীতে বিএনপি’র বর্ণাঢ্য বিজয় মিছিল, সমাবেশ “গণহত্যার দ্রুত বিচার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি”